জল-স্থল-অন্তরীক্ষ এক কথায় জীবের বাসোপযোগী যে কোন পরিবেশে বসবাসকারী অগণিত ছত্রাক আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের জীবনকালে এমন একটি দিনও নেই যেদিন কোন না কোন উপায়ে, প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে আমরা ছত্রাক দ্বারা উপকৃত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত না হই। আমাদের পরিবেশে বিপুল সংখ্যায় বসবাসকারী ছত্রাক খুব ধীর গতিতে ও নানাবিধ জৈবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ছত্রাকের এই ভূমিকাকে মোটামুটিভাবে দু'ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—উপকারী ভূমিকা ও অপকারী ভূমিকা।
ছত্রাকের উপকারী ভূমিকা :
* অধিকাংশ ছত্রাক ব্যাকটেরিয়ার সাথে একত্রে মৃত ও গলিত জৈববস্তুর (উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহ) উপর জন্মিয়ে এদের পচন ত্বরান্বিত করে। এরূপ পচনের ফলে ঐসব বস্তু মাটির সাথে সাররূপে মিশ্রিত হয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ।
* নানা প্রকার ঈস্ট জাতীয় ছত্রাক অর্থাৎ Saccharomyces-এর কয়েকটি প্রজাতি এবং Penicillium- এর কয়েক প্রজাতির সাহায্যে মদ, পাউরুটি, কেক, পনির প্রভৃতি প্রস্তুত করা হয়।*
* সাইট্রিক, গ্লুকোনিক, গ্যালিক, ফিউমারিক, গ্লুটামিক, অক্সালিক প্রভৃতি নানান জৈব এসিড, ভিটামিন এবং কয়েক প্রকার এনজাইম যেমন- ইনভার্টেজ, অ্যামাইলেজ, প্রভৃতি প্রস্তুত করতে কয়েক প্রজাতির ছত্রাক বর্তমানে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
*Mucor routi নামক ছত্রাকটিকে শ্বেতসার হতে চিনি প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়।
* বিভিন্ন ছত্রাক থেকে বিভিন্ন রকমের জীবাণু প্রতিরোধী (antibiotic) উৎপাদন করা হচ্ছে। ১৯২৯ সালে স্যার আলেকজাণ্ডার ফ্লেমিং সর্বপ্রথম Penicillium notatum নামক ছত্রাক থেকে Penicillin অ্যান্টিবায়োটিক। আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য বর্তমানে যেসব জীবাণু-প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহৃত হয় তার অনেকগুলোই ছত্রাকজাত ।
* বর্তমানে নিত্যনতুন অ্যান্টিবায়োটিক যেমন-স্ট্রেপটোমাইসিন, ক্লোরোমাইসিটিন, নিউমাইসিন, অ্যাম্ফিসিলিন, অরিওমাইসিন ইত্যাদি ছত্রাক থেকে প্রাপ্ত। * জৈবিক দমনের জন্য শস্যক্ষেত্রে কীটপতঙ্গের দেহে পরজীবীরূপে বাস করে বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক এদের ধ্বংস সাধন করে। এছাড়া মাটি বাহিত জীবাণুদের বিনাশ করতে বিশেষভাবে ছত্রাককে ব্যবহার করা হয়।
* ছত্রাকের ফ্রুটবডি সাধারণতভাবে ব্যাঙের ছাতা বা মাশরুম (Mushrooms), মোরেল (Morels), ট্রাফল (Truffles) প্রভৃতি নামে পরিচিত এবং উচ্চ প্রশংসিত খাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। এতে প্রচুর শর্করা ও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য উপাদান এবং নানান খনিজ লবণ পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান থাকে ।
* বিভিন্ন প্রজাতির ছত্রাক থেকে ভিটামিন B গ্রুপের বায়োটিন, প্যান্টেথেক এসিড, পিরিডক্সিন, রাইবোফ্ল্যাভিন প্রকৃতি ভিটামিন উৎপাদন করা হয়।
* উপগবেষণাগারে ছত্রাকের ব্যবহার বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে জিনতত্ত্বীয় গবেষণায় বিভিন্ন ছত্রাক ব্যবহৃত হচ্ছে, যথা-Neurospora crassa, Nisitophia প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
* Gibberalla fucikurai নামক ছত্রাক থেকে বৃদ্ধি সহায়ক হরমোন জিবেরেলিন উৎপাদন করা হয় ।
* Claviceps purpurea ছত্রাক থেকে ergot তৈরী হয় যা বিশেষ করে সন্তান প্রষণের পর রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* Aspergillus ছত্রাক ডায়াস্টেজ এবং জৈব এসিড তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়।
* মানুষের যেকোন অঙ্গ ট্রান্সপ্লান্ট করতে মরিকাবাসী ছত্রাক থেকে সাইক্লোস্পোরিন (cyclosporine) ঔষধ তৈরী হয়।
* Aspergillus থেকে স্টেরয়েড পাওয়া যায়, এটি আরথাইটিস নিরাময় করে।
* Penicillium griseofulvum থেকে গ্রিসিওফুলভিন তৈরি করা হয় যা দাদ বা চর্মরোগ নিরাময় করে।
ছত্রাকের অপকারী ভূমিকা (Harmful role):
* উদ্ভিদ দেহের যেসব রোগ হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছত্রাকজনিত। ছত্রাকের আক্রমণের ফলে আমাদের উদ্যান-বৃক্ষ, দারু-বৃক্ষ, ফসলী উদ্ভিদ ও ফলমূলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয় । * ১৯৪২ সালে তৎকালীন বাংলায় মহাদুর্ভিক্ষ হয়েছিল ধানের পাতার বাদামি দাগ রোগের কারণে। এই রোগ। Helminthosporium dryae নামক ছত্রাক দিয়ে সৃষ্টি হয়।
* আলুর বিলম্বিত ধ্বসা (লেট রাইট) রোগের কারণে ১৮৪৩-১৮৪৭ সাল পর্যন্ত আলুর ফলন প্রায় সম্পূর্ণটাই নষ্ট হয়ে যায়, যার ফলে আয়ারল্যাণ্ডে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা যায় এবং বিশ লক্ষ লোক দেশ ছেড়ে চলে যায়।
*Se Phytophthora infestans নামক ছত্রাক দ্বারা আলুর বিলম্বিত ধ্বসা রোগ হয় ।
ছত্রাকের কিছু কিছু প্রজাতি মানুষ ও গৃহপালিত পশু ও অন্যান্য প্রাণিদেহে নানাবিধ রোগ সৃষ্টি করে।
* বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমণে মানুষের দাদ, খুসকি, একজিমা, অ্যালার্জি প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি হয়। মানুষের। দেহে ব্রঙ্কোমাইকোসিস নামক রোগ সৃষ্টি করে Absidia corymbifera নামক ছত্রাক।
* Microsporum এর আক্রমণে চুল উঠে যায় এবং মাথায় টাক পড়ে।
*Saprolegnia মৃতজীবী ছত্রাক হলেও কখনো কখনো সুবিধাবাদী পরজীবী হিসেবে রুই, কাতলা, মৃগেল "প্রভৃতি মাছের দেহে বাস করে। এর আক্রমণে মাছ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
*নানা ধরনের ছত্রাক বিশেষ করে Mucor, Rhizopus, Aspergillus, Penicillium শাকসবজি, ফল-মূল, জ্যাম, জেলী, আচার, রান্না করা খাদ্য সামগ্রী নষ্ট করে দেয় ।
* বিভিন্ন প্রকার মৃতজীবী ছত্রাকের আক্রমণে চামড়া ও চামড়ার তৈরি দ্রব্যাদি, বইপত্র, মূল্যবান দলিলপত্র, ফটোগ্রাফ, দেয়ালে ঝুলানো মূল্যবান চিত্রকর্ম সবই নষ্ট হতে পারে।
*বর্ষাকালে কয়েকটি ছত্রাক প্রজাতির আক্রমণের কারণে ভেজা কাপড়-চোপড়, জুতা, চামড়ার সুটকেস ইত্যাদির উপর চিঠি পড়ে ঐ সব দ্রব্য ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে।
* কাঠ ও কাঠের আসবাব ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়।
Read more